কোটার যোগ্য না হয়েও ৯ বছর ধরে কোটায় চাকুরি করছেন শরীয়তপুরের অনন্যা

Date:

শরীয়তপুর প্রতিনিধি: শরীয়তপুরের ডামুড্যা ইউনিয়নের এক সহকারি শিক্ষিকার বিরুদ্ধে তথ্য লুকিয়ে বাবার কোটায় চাকরি নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।এ নিয়ে নানা মহলে আলোচনা সমালোচনা থাকলে অভিযুক্ত ওই শিক্ষিকার পরিবার স্থানীয় ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় প্রতিবাদ করতে পারেনি কেউ।এনিয়ে অভিযোগের ভিক্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে শরীয়তপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার।

কোটার যোগ্য না হয়েও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোটায় চাকুরি পেয়েছেন অনন্যা হক মেমী। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোটায় চাকুরি পেয়ে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে সরকারি রাজস্ব থেকে বেতন তুলছেন তিনি। এতে বঞ্চিত হয়েছে প্রকৃত চাকুরি প্রার্থীরা। চাকুরিতে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে চাকুরি প্রত্যাশীদের ব্যাপক ক্ষোভের এক পর্যায়ে কোটার যৌক্তিক সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে পতন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে অনন্যা হক মেমীর কোটায় চাকুরি পাওয়া নিয়ে স্থানীয় প্রাথমিক শিক্ষক ও চাকুরি প্রত্যাশীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

অনন্যা হক মেমী শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার বিশাকুড়ি গ্রামের মমিদুল হকের মেয়ে। বর্তমানে তিনি ডামুড্যার ৯নং বড় নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অনন্যা হক মেমীর বাবা মমিদুল হক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবরসপ্রাপ্ত শিক্ষক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানগণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকুরির ক্ষেত্রে পোষ্য কোটার সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু অনন্যা হক মেমী পোষ্য কোটার শর্ত ভঙ্গ করে তথ্য লুকিয়ে মিথ্যা তথ্য দ্বারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকুরিতে যোগদান করেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পোষ্য কোটায় চাকুরি পেতে হলে একজন চাকুরি প্রার্থীর বাবাকে অবশ্যই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বা অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক হতে হবে। এছাড়াও পোষ্য কোটার অন্যতম শর্ত চাকুরি প্রার্থীকে অবশ্যই অবিবাহিত ও বাবার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হতে হবে। এই শর্ত ভঙ্গ করলে একজন চাকুরি প্রার্থী কোনোক্রমেই পোষ্য কোটায় চাকুরি পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না।

অনন্যা হক মেমী ২০১২ সালের ২২ আগস্ট শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার ইকরাকান্দি গ্রামের সুলতান বেপারীর ছেলে স্কুল শিক্ষক মো. দুলাল হোসেনকে বিয়ে করেন। দুলাল হোসেনকে বিয়ের পরে অনন্যা হক মেমী স্বামীর উপর সর্ম্পণ নির্ভরশীল হন। এতে তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পোষ্য কোটার শর্ত ভঙ্গ হয়ে যায়। কিন্তু ২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এ বিজ্ঞপ্তির পরে অনন্যা হক মেমী তার বিয়ের তথ্য গোপন করে চাকুরিতে আবেদন করেন। নিয়োগ পরীক্ষার লিখিত ও ভাইবা পরীক্ষার পরে অনন্যা হক মেমী পোষ্য কোটায় চাকুরি পেয়ে যান। বিষয়টি নিয়ে তখন অন্যান্য সাধারণ কোটার চাকুরি প্রার্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও অনন্যা হক মেমীর চাচা ডামুড্যা পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজন মিজির ভয়ে কেউ মুখ খোলেননি। এভাবেই অনন্যা হক মেমী রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে প্রভাবিত করে নিজেকে কোটার যোগ্য বলে প্রমাণ করে ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি চাকুরিতে প্রথম যোগদান করেন। এরপর থেকে অনন্যা হক মেমী দীর্ঘ ৯ বছর যাবত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে চাকুরি করে সরকারের রাজস্ব থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হলে অনন্যা হক মেমী ও তার বাবা স্থানীয়দের নিয়ে ডামুড্যা পৌরসভার নিকাহ রেজিস্টার (কাজী) সাইফুল ইসলামের কাছে গিয়ে বিবাহের তারিখ ২০১৫ সাল দেখিয়ে একটি নিকাহনামা তৈরী করে দিতে বলেন। কিন্তু মেমী ও তার পরিবারের অনৈতিক এমন প্রস্তাবে রাজি হোননি নিকাহ রেজিস্টার। কোটার যোগ্য না হয়েও অনন্যা হক মেমীর কোটায় চাকুরি পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন বঞ্চিত চাকুরি প্রত্যাশী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৈধ উপায়ে চাকুরিরত শিক্ষক ও স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তথ্য গোপন করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকুরি পাওয়া অনন্যা হক মেমীর বিচারসহ তার চাকুরি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা তাকে সহায়তা করেছে তাদেরও বিচার দাবি করেছেন তারা।

অনন্যা হক মেমীর বর্তমান কর্মস্থল ৯ নং বড় নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা এবিষয়ে জানতে চাইলে অনন্যা হক মেমী ফোন করে তার বাবা মমিদুল হক ও চাচা সুজন মিজিকে ডেকে আনেন। মমিদুল হক ও সুজন মিজি এসে বৈধ উপায়ে মেমী চাকুরি পেয়েছে বলে দাবি করেন। অনন্যা হক মেমী সাধারণ কোটায় চাকুরি পেয়েছে এমন প্রমাণপত্র দিবেন বলে তারা গণমাধ্যমকর্মীদের মেমীর বাসায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। গণমাধ্যম কর্মীরা বাসার কাছাকাছি গেলে সুজন মিজি ও মমিদুল হক গণমাধ্যমকর্মীদের ঘুষের প্রস্তাব করে সংবাদটি পরিবেশন করতে বারণ করেন। এতে গণমাধ্যম কর্মীরা রাজি না হলে বিভিন্নভাবে তাদেরকে প্রভাবিত করার চেষ্টাও করেন তারা।

ডামুড্যা পৌরসভার নিকাহ রেজিস্টার সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০১২ সালের ২২ আগস্ট অনন্যা হক মেমী ও দুলাল হোসেনের বিয়ে রেজিস্টার ভুক্ত করেছেন ডামুড্যা পৌরসভার প্রাক্তন নিকাহ রেজিস্টার (কাজী) মরহুম হুমায়ুন রশিদ। তাদের বিয়ের রেজিস্টারের ভলিয়ম নাম্বার ২, ক্রমিক নং ১১০, পৃষ্ঠা নং ৬৭, সন ২০১২। ওই দিনই তাদের বিয়ে হয়েছিল। ২০১৫ সালে হুমায়ুন রশিদের চাকুরির মেয়াদ শেষ হয় এবং তিনি মারা যান । এরপর থেকে আমি নিকাহ রেজিস্টার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলে হুমায়ুন রশিদের যাবতীয় বালাম বইসহ ডকুমেন্টসগুলো আইন অনুযায়ী আমার তত্ত্বাবধায়নে রয়েছে।

অনন্যা হক মেমীর স্বামী দুলাল হোসেন বলেন, অনন্যা হক মেমীর সঙ্গে আমার বিয়ে হয় ২০১২ সালের ২২ আগস্ট। আমাদের হুমায়রা ইসলাম নামে এক মেয়ে রয়েছে। হুমায়রার জন্ম ২০১৪ সালের ২২ মে। কিন্তু অনন্যা হক মেমী মেয়ের জন্ম তারিখ কাগজপত্রে ২০১৫ সালে দেখিয়েছে। অনন্যা হক মেমী যখন চাকুরির জন্য আবেদন করে, তখন সে সম্পূর্ণভাবে আমার উপর নির্ভরশীল ছিল। চাকুরিতে আবেদনসহ বিভিন্ন আনুষাঙ্গিক খরচ আমি বহন করেছি। চাকুরি পাওয়ার পরে আমার সঙ্গে অনন্যার ডিবোর্স হয়ে গেছে।

৯ নং বড় নওগাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজনীন নাহার বলেন, অনন্যা হক মেমী চাকুরিতে প্রথম যোগদান করেন ২০১৬ সালের জানুয়ারী মাসে। আমার বিদ্যালয়ে ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি যোগদান করে চাকুরি করছেন। তিনি সাধারণ কোটায় নাকি পোষ্য কোটায় চাকুরি পেয়েছেন, তা আমি জানি না।

ডামুড্যা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সুকন্ঠ ভক্ত বলেন, যদি কোনো শিক্ষকের সন্তান বিবাহিত হয়ে থাকেন বা তার চাকুরির আবেদন যদি বিয়ে হওয়ার পরে করে থাকেন তাহলে তিনি পোষ্য কোটা পাবেন না। যদি কোনো প্রার্থী এই নিয়মের ব্যক্তয় ঘটিয়ে থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক শিক্ষা অফিস যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

বিষয়টি নিয়ে শরীয়তপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. নূরুল হাসান বলেন, পোষ্য কোটায় যদি কেউ চাকুরি পেয়ে থাকেন এবং সে যদি তথ্য গোপন করে এর ব্যক্তয় করে থাকেন। তাহলে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Share post:

Subscribe

spot_img

Popular

More like this
Related

ইসলাম ক্ষমতায় গেলে নারীরা মর্যাদা ও নিরাপত্তা পাবে- ডা. শফিকুর রহমান

কুমিল্লা প্রতিনিধি : জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান...

কুমিল্লা সদর দক্ষিণে ধর্মীয় র‍্যালি ও সম্প্রীতি সভা অনুষ্ষ্ঠিত

কুমিল্লা প্রতিনিধি :ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ ছড়াবে না বিদ্বেষ’- এই স্লোগানকে...

আগরতলায় বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে শ্রীমঙ্গলে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক :ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদ...