ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার: গত পাঁচ মাস আগেও সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদের মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রামকৃষ্ণ মিশন রোডে অবস্থিত বাংলো টাইপ বাসাটি দিনরাত হাজারো মানুষের পদচারণায় সরগরম থাকতো। কিন্তু এখন এটি যেন এক ভুতুরে বাসা। দীর্ঘদিন ধরে এ বাসাটি ছিল জেলার রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। বাসাটির নিরাপত্তা বিধানে সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকতো পুলিশ। ক্ষনে ক্ষনে শুনা যেত পুলিশের হুইসেলের শব্দ। কেয়ারটেকার, দারোয়ান, পিয়ন, বাবুর্চিসহ বেশ কয়েকজন স্টাফ ছিল বাসাটিতে। দুই অংশে বিভক্ত বাসাটিতে উত্তর পাশে ডুপ্লেক্স ভবন ও দক্ষিণ পাশে একটি টিন শেডের ঘর। এর মাঝে ফুল ও ফলের গাছের সারি। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগি সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের আনাগোনায় বাসাটি থাকতো সরগরম। কে কোন দায়িত্ব পালন করবেন, চাকুরি, পদায়ন, ঠিকাদারী ব্যবসা, বালু ব্যবসা, গাছ ব্যবসা থেকে শুরু করে স্থানীয় নির্বাচনে কারা প্রার্থী হবেন সবকিছু নির্ধারিত হতো এ বাসা থেকে। মো. আব্দুস শহীদের দীর্ঘদিনের একচ্ছত্র সামাজ্যে যারা এ বাসাটিতে এসে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীতার জন্য মাথায় হাতের ছোঁয়া লাভ করেছেন অথবা সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বদলী, পদায়ন, ঠিকাদারী, অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য বাগিয়ে নিতে পেরেছেন তাদের জন্য বাসাটি ছিল আর্শীবাদের। আর সাধারণ মানুষ এবং যারা ব্যর্থ মনোরথে এ বাসা থেকে ফিরে যেতে হয়েছে তাদের জন্য বাসাটি অভিশাপের। জেলার এক সময়ের একচ্ছত্র ক্ষমতাবান আব্দুস শহীদের দীর্ঘদিনের সা¤্রাজ্যের পতনের পর বাসাটিতে এখন কবরের নিস্তব্ধতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পর বিক্ষুব্ধ হাজার হাজার ছাত্র-জনতা জেলার রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা বাসাটিতে হামলা চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। ওই সময়ে সাধারণ ছাত্র-জনতার ভাষ্য ছিল বাসাটি জেলার দুর্নীতিবাজদের জন্য আর্শীবাদের হলেও অধিকাংশ সাধারণ মানুষের জন্য অভিশাপের। অনেক অত্যাচার-নির্যাতনেরও নিরব সাক্ষী এ বাসাটি। বিরোধী দল ও মত দমনের পরিকল্পনা হতো এ বাসাতেই। এমনকি আব্দুস শহীদের নিজ দলের প্রতিদ্ব›দ্বীদের কিভাবে শায়েস্তা করা হবে তার পরিকল্পনার নিরব সাক্ষীও এ বাসাটি।
জানা যায়, ১৯৭৩ সালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ গণ মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন মো. আব্দুস শহীদ। দীর্ঘদিন তিনি এ পেশায় নিয়োজিত ছিল। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি মৌলভীবাজার-৪ (শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলা) আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথমবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হবার পর জাতীয় সংসদের হুইপ, ২০০১ সালে তৃতীয়বার সংসদ সদস্য হবার পর বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ, ২০০৮ চতুর্থবার সংসদ সদস্য হবার পর জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ, ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্ব›দ্বীতায় পঞ্চমবার সংসদ সদস্য হবার পর সরকারি প্রতিশ্রæতি সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি, ২০১৮ সালে ষষ্ঠবার সংসদ সদস্য হবার পর অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে একতরফা নির্বাচনে সপ্তমবার সংসদ সদস্য হবার পর কৃষিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। এর মাঝে তিনি বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত মো. আব্দুস শহীদের ছিল নিজস্ব একটি ৫০ সিসি মোটরসাইকেল। এটি চালিয়েইে তিনি বাড়ি থেকে কলেজ আর কলেজ থেকে বাড়িতে যাতায়াত করতেন। পৈত্রিক সম্পদ ছাড়া আর কোন সম্পদ তার ছিল না। ১৯৯১ সালে প্রথম তিনি সংসদ সদস্য হন। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বিতীয়বার জয়লাভ করার পর তিনি জাতীয় সংসদের হুইপ নিযুক্ত হন। সেখান থেকেই তার উত্থান শুরু। মো. আব্দুস শহীদ ৩৩ বছর ছিলেন সংসদ সদস্য হিসেবে ছিলেন ক্ষমতার মসনদে। এ সময়ে তিনি গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জমি দখল করে গড়ে তুলেছেন চা বাগান, কিনেছেন বিমা কোম্পানি, কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সিবাজারে বাড়ি, ঢাকার উত্তরায় সুবিশাল ফ্লাট ও যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার বেগম পাড়ায় রয়েছে একাধিক বাড়ির মালিক তিনি।
শনিবার সকালে তিন দশক ধরে সাধারণ মানুষের কাছে আলোচ্য আব্দুস শহীদের বাসাটিতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। বাসাটিতে যেন কবরের নিস্তব্ধতা। কোন আসবাসপত্র নেই। সবগুলো দরজা খোলা অবস্থায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, ৫ আগস্টের পর এ বাসাতে কেউ থাকেন না। বাসাটিতে ছাত্র-জনতার হামলার পর স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে বাসাটির মূল ফটকে বেড়া দেয়া হয়েছে। সন্ধ্যার পর এ বাসাটির অভ্যন্তরে ভয়ে কেউ যায় না। আশপাশের বাসাগুলো আলোকিত থাকলেও এ বাসাটি থাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত। অথচ দীর্ঘ তিন দশকে এ বাসাটির কল্যাণেই পুরো রামকৃষ্ণ মিশন রোড এলাকা লোডশেডিংমুক্ত থাকতো।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও চা শ্রমিক নেতা প্রেমসাগর হাজরা গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘বিগত দিনে আওয়ামী লীগের নামে তারা যা কিছু করেছে এই বাসাটিতে এখন তার ছবি ফুটে ওঠেছে।’
মৌলভীবাজার জেলার অধিকাংশ বাসিন্দাদের কাছে ‘বড় হুজুর’ বা ‘মহাদেব’ নামে পরিচিত মো. আব্দুস শহীদ জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ থাকাকালে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কমলগঞ্জের পৈত্রিক বাড়িতে সরকারি খরচে প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন টেনে নিয়ে গ্যাস সংযোগ এবং ২০১৯ সালে নন্দরানী চা বাগানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জোড়া খুনের ঘটনায় তার সম্পৃৃক্ততা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়। তিনি দলের পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের পাশ কাটিয়ে তার তিন ভাই ও মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন পাদপ্রদীপের আলোয়। নিজের প্রভাব খাটিয়ে ভাই ইমতিয়াজ আহমদ বুলবুলকে কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইফতেখার আহমদ বদরুলকে রহিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বানান। অপর ভাই মোসাদ্দেক আহমদ মানিককে বানিয়েছিলেন কমলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। বড় মেয়ে উম্মে ফারজানা ডায়নাকে শ্রীমঙ্গল উপজেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের পদ দিয়ে তিনি রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তাকে নিজের সঙ্গে রাখতেন। সর্বত্র মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দিতেন। উদ্দেশ্য ছিল আগামীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডায়নাকে প্রার্থী করা। এ নিয়েও দুই উপজেলার দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজমান ছিল।
গত বছরের ২৯ অক্টোবর গভীর রাতে নগদ ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা, বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ও ৭৫ ভরি স্বর্ণালংকারসহ ঢাকার উত্তরার নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন বর্তমানে ‘রূপকথার খলনায়ক’ হিসেবে পরিচিত মো. আব্দুস শহীদ। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম ও শ্রীমঙ্গল থানায় হত্যা ও হত্যা চেষ্টার ৫টি মামলা রয়েছে।